বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
spot_img

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। জাহাজটিকে সোমালিয়া উপকূল থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকে আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই। নাবিকেরা জাহাজের মালিকপক্ষের সাথে যেমন যোগাযোগ করেননি, তেমনি পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেননি। দস্যুরাও কোনো দাবি–দাওয়া নিয়ে যোগাযোগ করেনি। জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলের প্রায় ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে গভীর সাগরে অবস্থান করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধ জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে। জাহাজ দুটি জিম্মি হওয়া জাহাজটির এক মাইলের মধ্যে অবস্থান করছে।

শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিম্মি হওয়া নাবিকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ওই দুটি জাহাজ থেকে কোনো অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। কমান্ডো অপারেশন চালানোর মতো অবস্থাও নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অপরদিকে সোমালিয়ায় কোনো সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থা না থাকায় সরকারি পর্যায়ে আলোচনারও খুব বেশি সুযোগ নেই। বিভিন্ন দল, উপদল, গোষ্ঠী এবং উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত ক্ষমতাশালীরা নিজেরাও জাহাজ জিম্মির অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভাগিদার। এদের অনেকেই জাহাজ ডাকাতির জন্য জলদস্যুদের পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করে এবং আদায়কৃত পণের বড় অংশ হাতিয়ে নেয়। বিশ্বের নৌবাণিজ্য রুটের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা অঞ্চলটিতে মূলত কারো একক নিয়ন্ত্রণ নেই।

সোমালিয়ার যে উপকূলে এমভি আবদুল্লাহকে প্রথমে নোঙর করা হয়েছিল সেখানকার শাসনে যারা জড়িত তাদের সাথে দস্যুদের সম্ভবত বনিবনা হয়নি। ফলে জাহাজটিকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জাহাজটিকে সরানোর পর থেকে নাবিকদেরকে আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে জাহাজটির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে গতকাল নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। তবে জাহাজটিতে যেহেতু ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে এবং কয়লা যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য, তা দস্যুদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে। জাহাজটির হ্যাজে থাকা কয়লার তাপমাত্রা ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিস্ফোরণ ঘটবে; যা শুধু জাহাজ কিংবা জিম্মি হওয়া নাবিকদের নয়, দস্যুদেরও বিপদের কারণ হবে। এজন্য জাহাজের নাবিকদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করার ব্যাপারে দস্যুরা অনুমোদন দিয়েছে। শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ভালো খবর যে, কয়লায় যাতে বিস্ফোরণ না ঘটে সেজন্য নাবিকদের কোনো ক্ষতি দস্যুরা করবে না।

জাহাজের ফোন না আসায় জিম্মি হওয়া নাবিকদের স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দস্যুরা নিজেরাও কোনো দাবি নিয়ে ফোন না করায় নাবিকসহ জাহাজটি উদ্ধারের আলোচনাও শুরু করা যাচ্ছে না। মালিকপক্ষ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দস্যুদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে গত রাত পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া মিলেনি।

প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত সোমালিয়া গৃহযুদ্ধের পর থেকে বিধ্বস্ত একটি দেশ। আইনশৃঙ্খলা বা নিয়ম কানুনের চর্চা বেশি নেই দেশটিতে। ঘরে ঘরে অস্ত্র। জলদস্যুতাই তাদের আয়ের একটি বড় অংশ দখল করে রয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এ নৌরুটে নিয়মিত জাহাজ ছিনতাই এদের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বছর ধরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা জাহাজ ছিনতাই এবং মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। বছরে গড়ে ২শটিরও বেশি জাহাজ জিম্মি করার রেকর্ডও রয়েছে। বিশ্বের নৌবাণিজ্যের কথা চিন্তা করে সোমালিয়ার এই রুটে নিয়মিত টহল এবং অভিযান চালানো শুরু করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ক্ষমতাশালী বাহিনী। দক্ষ এবং অত্যাধুনিক নৌবাহিনীর অভিযানের মুখে সোমালি দস্যুরা গত বছর কয়েক দমে যায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি এসে দ্য ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিংসহ ছয়টি আন্তর্জাতিক শিপিং সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রুপ সোমালিয়া উপকূলকে শিপিং সেক্টরের জন্য আর হুমকি নয় বলে ঘোষণা দেয়। তারা ভারত মহাসাগরের এই রুটকে জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ করায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ দেয়। কারণ ২০১৮ সাল থেকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের মাধ্যমে কোনো বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ হয়নি। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে লোহিত সাগরের হুথি হামলা ঠেকানোর তৎপরতায় সবার চোখ যখন ভারত মহাসাগর থেকে সরে যায়, তখন নতুন করে সোমালি দস্যুরা সাগরে নামে। গত তিন মাসে তারা বেশ কয়েকটি বড় জাহাজ জিম্মি করে। সোমালি জলদস্যুদের পাশাপাশি দেশটির বিভিন্ন এলাকার ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় দস্যুরা শক্তি সঞ্চয় করে সাগরে নামে। এতে করে শান্ত হওয়া রুটটি নতুন করে বিশ্বের শিপিং সেক্টরের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে ওঠে।

ওই রুটে একাধিকবার যাতায়াতকারী শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালি দস্যুরা শুধুমাত্র অর্থের জন্য নাবিকসহ জাহাজ অপহরণ করে। মুক্তিপণ হিসেবে পাওয়া অর্থের বড় অংশ চলে যায় ডাকাতদের পেছনে যারা অর্থ বিনিয়োগ করে তাদের হাতে। জলদস্যুদের যারা অর্থায়ন করে তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তাই জাহাজ জিম্মি করে নিয়ে যাওয়ার পর সেটি অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। ডাকাতদের পেছনে অর্থ বিনিয়োগকারীরা পুরো প্রক্রিয়ার সাথে থাকে।

একজন ক্যাপ্টেন বলেন, দর কষাকষি করে যে পণ আদায় করা হয় তার অন্তত ৩০ শতাংশ চলে যায় বিনিয়োগকারীদের হাতে। বিশাল অংকের এই নগদ ডলারের লোভই জলদস্যুতাকে টিকিয়ে রেখেছে। যেসব দস্যু জাহাজে উঠে নাবিকদের জিম্মিসহ জাহাজটি দখল করে তারা ১/২ শতাংশের বেশি পায় না বলে জানান তিনি।

এমভি আবদুল্লাহর মুক্তিপণের ব্যাপার নিয়ে মধ্যস্বত্বকারীদের ভূমিকা এবং দাবির বিষয়টি ঠিক করতে তারা সময় নিচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাদের ফোন না আসা পর্যন্ত জাহাজটির মালিকপক্ষের বেশি কিছু করার নেই।

সব নাবিক সুস্থ আছেন : চট্টগ্রামে অবস্থানকারী ক্যাপ্টেন আতিক খান জাহাজের এক নাবিকের ভয়েস মেসেজের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, এমভি আবদুল্লাহর নাবিকেরা সবাই সুস্থ আছেন এবং সোমালিয়ার জলদস্যুদের অধীনেই রয়েছেন। ভারতীয় নৌবাহিনী ওদেরকে উদ্ধার করেছে–এই সংবাদের সত্যতা নেই। মিডিয়ায় এই নিউজটা দেখে ওরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ওরা চান মানুষ সত্যটা জানুক।

ওই নাবিক জানান, সোমালিয়ার উপকূলে অগ্রসর হওয়ার সময় ইউরোপ ও ভারতীয় নেভির দুইটা যুদ্ধজাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যুদের থামতে বলেছে। ওয়ার্নিং দিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলেছে আর আশপাশে পানিতে গোলাগুলি করেছে। কিন্তু জলদস্যুরা নির্বিকার ছিল এবং ওদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেনি।

এ সময় জলদস্যুরা মনে করেছিল বাংলাদেশের নাবিকরা ওদেরকে ডেকে এনেছে। তাই ওরা কিছুটা রাগ করে সবাইকে ব্রিজে ডেকে বন্দুকের মুখে রেখেছিল। পরে ক্যাপ্টেন রেডিওতে ভারতীয় নেভিকে দূরে সরে যেতে বললে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

ক্যাপ্টেন আতিক জানান, জলদস্যুদের দোভাষী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি বাংলাদেশের টিভি আর মিডিয়ার ওপর চোখ রেখেছে। তাই গুজব রটানো বা নাবিকরা বিপদে পড়ে এমন কিছু যেন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়ানো না হয় সেদিকে সতর্ক থাকার জন্য জিম্মি ওই নাবিক অনুরোধ জানিয়েছেন।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here