ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১ম অংশ।
বিশেষ প্রতিবেদন।
২৮/১০/২৪
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক আনোয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। বিশেষ করে প্রায় ১৫ বছর তিনি পূর্বাঞ্চল রেলের সরঞ্জাম বিভাগে বিভিন্ন লাভজনক পদে কর্মরত আছেন তিনি আর সাবেক রেলমন্ত্রী নরুল ইসলাম সুজনের ভাগ্নি জামাই হওয়ার সুবাধে রেলের ২/৩ টি পদের দায়িত্বের পাশাপাশি এখনো চট্টগ্রামে তিনি পরিচালক ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোলের দায়িত্ব পালন করছেন।সেই সুবাদে তিনি অবৈধ ভাবে লুটপাট করছেন রেলের কোটি কোটি টাকা।
চট্টগ্রামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে সরঞ্জাম ক্রয়ের দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে রেলের পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনেও। অডিট অধিদপ্তর সূত্রমতে, পূর্ব রেলের সরঞ্জামের বিভিন্ন খাতে সরকারের কত কোটি টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে তার হিসাব মিলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিরীক্ষা কর্মকর্তাদের। এরপরও কত কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে তার সঠিক অঙ্ক নিরীক্ষা কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে পারে নি।
তদন্তে ‘দোষী’ প্রমাণিত হয়েও বহাল তবিয়তে আছেন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকে অনোযারুল ইসলাম।সাবেক রেলমন্ত্রী নরুল ইসলাম সুজনের ভাগ্নি জামাই হওয়ার সুবাধে ২০১৮ সালের নির্বাচনে নুরুল ইসলাম সুজন রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর আনোয়ারুল ইসলাম চট্টগ্রামে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে ৫ মণ মিষ্টি বিতরণ করেন।
২০২০ সালে করোনা সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির জন্য পূর্বাঞ্চল রেলের ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছিলো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কমিটি। ২১ জনের মধ্যে ছিলেন সেই সময় অতিরিক্ত সিসিএস মো. আনোয়ারুল ইসলাম। কিন্তু এই সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেও রহস্যজনক কারণে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনেনি দুদক।
পূর্ব রেলের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন মেশিনারিজ মালপত্র, বাজারদরের চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে লুট করেছেন রেলের কোটি কোটি টাকা। অনোযারুল ইসলাম ছিলেন সেই সময় সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ছিলেন রুহুল কাদের আজাদ ও সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল হোসেন সরকারের নিজ্বস কিছু ঠিকাদার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, বুলবুল কর্পোরেশন, মডার্ন ইন্টারন্যাশনাল, তাসফিয়া করপরেশন, জান্নাত এন্ড ব্রাদার্স, মোহাম্মাদিয়া কর্পোরেশন, এস এ কর্পোরেশন সহ এই বিশাল সিন্ডিকেট থেকে অবৈধ অর্ৎের বিনিময়ে পাইযে দিযেছেন টেন্ডার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পূর্ব রেলের কোচের এসি মেরামতের জন্য বিভিন্ন মালপত্র কেনা হয়। এক্ষেত্রেও প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে বেশি দাম নেয় তারা। এছাড়া, বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনা হয়েছে প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে দ্বিগুণ দামে। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
২০২২/২৩ অর্থ বছরে সবচেয়ে বড় বিক্রয় দরপত্র ছিল ৮ আইটেমের ১৪০৯ দশমিক ০১৫ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ মালামাল বিক্রয় (দরপত্র প্যাকেজ নং সেল/২২/২০২৩)। এই দরপত্রেও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তথ্যনুন্ধানে দেখা যায় প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক তার নিজ্বস কিছু ঠিকাদার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, বুলবুল কর্পোরেশন, মডার্ন ইন্টারন্যাশনাল, তাসফিয়া করপরেশন, জান্নাত এন্ড ব্রাদার্স, মোহাম্মাদিয়া কর্পোরেশন, এস এ কর্পোরেশন কে দরপত্রটি পাইযে দেওয়ার জন্য লোক দেখানো উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করে। এবং নোটিশটি গত ১৫/৯/২৩ তারিখে দৈনিক বাংলাদেশ টুডে ও দৈনিক পূর্বদেশ এবং ১৬/৯/২৩ তারিখে দৈনিক যায়যায় দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই দরপত্রেও ঢাকাতে ১টি, রাজশাহীতে ১টি এবং চট্টগ্রামের ১টিসহ মোট ৬টি স্থানে দরপত্র দলিল ক্রয় ও দরপত্র দাখিলের সুযোগ ছিল। দরপত্র নির্ধারিত সময়ে দরপত্রদাতাগণের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে উন্মুক্ত করা হয়। দরপত্র উন্মুক্তকরণের পর মূল্যায়নের জন্য দরপত্র মুল্যায়ন কমিটির আহবায়ক তথা অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) এর সভাপতিত্বে রেলভবনের ৪১১ নং কক্ষে দরপত্র মূল্যায়ন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সুত্র জানায় একাধিক স্থানে দরপত্র দলিল ক্রয় ও জমা দেয়ার সুযোগ রাখায় টেন্ডার কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে টনপ্রতি ৫৫ হাজার ৮৬১ ও ৫৫ হাজার ৮৫১ টাকা ৩০ পয়সা দরে ১৪০৯.০১৫ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ এর দাম ৭ কোটি ৮৭ লাখ ৮ হাজার ৫৮৬ টাকা দর দিয়ে এস এ কর্পোরেশন সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়। একই পরিমাণ স্ক্র্যাপের ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৩ হাজার ২৭০ দশমিক ৭২৫ টাকা দর দিয়ে সজীব এটারপ্রাইজ ২য় সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহবায়ক বাংলাদেশ রেলওয়ের এডিজি (আরএস), সদস্য সিএমই/পূর্ব, রেল মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (উন্নয়ন) ও গণপূর্ত বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সদস্য সচিব সিওএস (পূর্ব) এর মতামতের ভিত্তিতে রেলের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) এই টেন্ডার অনুমোদন করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে। পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ও টেন্ডার কমিটির সদস্য-সচিব ছিলেন প্রকৌশলী মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম। এবার পুর্বের তুলনায় আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু তদন্তে দেখা যায় বাজার মুল্যর চেয়ে অন্তত ২০ টাকা কেজি কমে এস এ করর্পোরেশন কে কাজ টি পাইযে দেয় প্রধান সরঞ্জাম নিযন্ত্রক অনোযারুল ইসলাম। এতে রেলের ক্ষতি হয কযেক কোটি টাকা।
২০২৩/২৪ অর্থ বছরে তিনটি আইটেম মোট ৬৬, ৩৬৬৩৮৭মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ মালামাল বিক্রয় (দরপত্র প্যাকেজ নং সেল/২২/২০২৪) এই দরপত্রেও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে। বিক্রয় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি (একাধিক প্যাকেজের যৌথ নোটিশ) তারিখ ১০-০৯-২৪ ইং এর দরপত্রের বিক্রয় এর শেষ তারিখ ছিল ২২-১০-২৪ ইং। কিন্তু কোন কারণ ছাডা প্রধান প্রকৌশলী টেন্ডারটি খোলার তারিখ বার বার পর্রিবতন করতে থাকে। কম মূল্যে স্ক্র্যাপ মালামাল নেওয়ার জন্য একের পর এক তারিখ নির্ধারণ করে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের বিশ্বত এই স্ক্র্যাপ সিন্ডিকেটর ঠিকাদার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, বুলবুল কর্পোরেশন, মডার্ন ইন্টারন্যাশনাল, তাসফিয়া করপরেশন, জান্নাত এন্ড ব্রাদার্স, মোহাম্মাদিয়া কর্পোরেশন, এস এ কর্পোরেশন সদস্যরা।
বিশ্বত সুত্র মতে, ঠিকাদার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, বুলবুল কর্পোরেশন, মডার্ন ইন্টারন্যাশনাল, তাসফিয়া করপরেশন, জান্নাত এন্ড ব্রাদার্স, মোহাম্মাদিয়া কর্পোরেশন, এস এ কর্পোরেশনের সদস্যরা মিলে প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম এর সাথে গোপনে বৈঠক করে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি সংশোধনী /সংযোজনী করে নতুন তারিখ নির্ধারণ করেন ১৯-১১-২৪ ইং।এভাবে স্ক্র্যাপ সিন্ডিকেটের সদস্যরা কম মূল্যে স্ক্র্যাপ নেওয়ার জন্য একের পর এক নতুন সময় নির্ধারন করে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলামের সহায়তায়। এইভাবে বছরের পর বছর রেলের টাকা এ-ই ভাবে হরিলুট করে যাচ্ছে প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
এদিকে একাধিক ঠিকাদার স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী বলেন, আমরা বছরের পর বছর লাইসেন্স নবায়ন করার পরও কোন কাজকর্ম করতে পাচ্ছি না আমরা দরপত্র কেনার পরও শুনতে পারি শুধু তারিখ আর তারিখ পরিবর্তন হচ্ছে যাতে আমরা দলপত্র অংশগ্রহণ করতে না পারি তাই প্রশাসনের কাছে আমাদের অনুরোধ প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম সহ তার বিশাল এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে যেন আমরা মুক্তি পায়।